Tuesday, September 6, 2011

চুক্তি না হলেও তো চলে -আ ব দু ল ম তি ন খা ন, Oped 7 Sept.2011 Daily Amardesh

 "ব্রিটিশ ..দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ..বুঝে গিয়েছিল ..উপনিবেশ থেকে মানসম্মান নিয়ে তাদের কেটে পড়তে হলে উপনিবেশের মানুষের সশস্ত্র লড়াই শুরুর আগেই তাদের স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্বাধীন করে দেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। ..চার্চিল .. বললেন, স্বাধীনতা দিয়েও সাবেক উপনিবেশকে প্রকৃত উপনিবেশের মতো রাখা যায় যদি সেখানে তাদের পা রাখার মতো একটি জায়গা রেখে আসা যায়। চার্চিলের এ চিন্তার ফসল হলো আজকের পরস্পর শত্রু ভাবাপন্ন ত্রিখণ্ডিত ভারতীয় উপমহাদেশ। ..বিভেদ সৃষ্টিতে সফল হওয়াতেই পাশ্চাত্যের ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পেয়ে গেছে উপমহাদেশে তাদের পা রাখার স্থায়ী জায়গা। উপমহাদেশকে চেতনাগতভাবে বিভক্ত করতে না পারলে আজ বিশ্ব রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন আকার নিত। পাশ্চাত্যের মুখ থুবড়ে পড়ার দিন আসত বহু এগিয়ে। ভারতবর্ষ ভাগ করে এবং এক দেশকে অন্য দেশের শত্রু করে তারা তাদের পতনের সেই ক্ষণটি পিছিয়ে দিতে পেরেছে। চাতুর্যে চার্চিল ক্লাইভের চেয়ে একটুও পিছিয়ে নন।.....ব্রিটেনের দখলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু ছিল না। ১৮৫৭ সালে সংঘটিত ভারতব্যাপী সিপাহি বিদ্রোহের আগ পর্যন্তও ভারতীয়রা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কী তা জানত না। ভারতবর্ষে বহু ধর্মের ও বহু সম্প্রদায়ের বাস। ভারতীয়দের প্রকৃতিই এমন যে, তারা সব মত ও পথের প্রতি সমান সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাপরায়ণ। ফলে যে যার মতো স্বাধীনভাবে তার নিজস্ব ভাবনার পথে চলতে পারত।.."


http://www.amardeshonline.com/pages/details/2011/09/07/103692

সম্পাদকীয়  ঢাকা, বধুবার ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১১, ২৩ ভাদ্র ১৪১৮, ০৮ শাওয়াল ১৪৩২ হিজরী  

চুক্তি না হলেও তো চলে

আ ব দু ল ম তি ন খা ন
দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে অবশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং গতকাল ঢাকা এসেছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অমীমাংসিত কতগুলো বিষয় নিয়ে চুক্তি করা। এ বিষয়গুলো ভারত বিভাগ থেকে সৃষ্ট। ব্রিটিশ ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ভাগ করতে সফল না হলে এসব সমস্যার সৃষ্টি হতো না। কট্টর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ নেতা স্যার উইনস্টোন চার্চিল চাইতেন না দুনিয়াব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্য লোপ পাক। ব্রিটিশ জাতি বাস্তববাদী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তারা বুঝে গিয়েছিল যুদ্ধের পর যে সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, সেটি আর থাকছে না। সব উপনিবেশ থেকে মানসম্মান নিয়ে তাদের কেটে পড়তে হলে উপনিবেশের মানুষের সশস্ত্র লড়াই শুরুর আগেই তাদের স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্বাধীন করে দেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে ব্রিটেনের মর্যাদা বাড়বে। উপনিবেশের মানুষ তাদের এ বদান্যতার কথা মনে রেখে তাদের প্রতি থাকবে কৃতজ্ঞ ও অনুগত। রাজ্য হারিয়েও তারা প্রভাব হারাবে না।

চার্চিল যে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের এ চিন্তাধারার সঙ্গে দ্বিমত ছিলেন তা নয়। তিনি তাদের বললেন, স্বাধীনতা দিয়েও সাবেক উপনিবেশকে প্রকৃত উপনিবেশের মতো রাখা যায় যদি সেখানে তাদের পা রাখার মতো একটি জায়গা রেখে আসা যায়। চার্চিলের এ চিন্তার ফসল হলো আজকের পরস্পর শত্রু ভাবাপন্ন ত্রিখণ্ডিত ভারতীয় উপমহাদেশ। উপমহাদেশ আজ তিন খণ্ড কেবল ভূমিগতভাবে নয়, চেতনাগতভাবেও। চেতনার বিভেদটাই আসল বিভেদ। চেতনার বিভেদ সৃষ্টিতে সফল হওয়াতেই পাশ্চাত্যের ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পেয়ে গেছে উপমহাদেশে তাদের পা রাখার স্থায়ী জায়গা। উপমহাদেশকে চেতনাগতভাবে বিভক্ত করতে না পারলে আজ বিশ্ব রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন আকার নিত। পাশ্চাত্যের মুখ থুবড়ে পড়ার দিন আসত বহু এগিয়ে। ভারতবর্ষ ভাগ করে এবং এক দেশকে অন্য দেশের শত্রু করে তারা তাদের পতনের সেই ক্ষণটি পিছিয়ে দিতে পেরেছে। চাতুর্যে চার্চিল ক্লাইভের চেয়ে একটুও পিছিয়ে নন।

ভারতবর্ষ ভাগের ফল চোখ যার আছে তার নজর এড়িয়ে যাওয়ার নয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস দীর্ঘ। দীর্ঘ ইতিহাসের গোড়া থেকেই দেখা যায় ভারতীয়রা প্রথমাবধি সভ্যতার শেষ ধাপ নগর সভ্যতায় কম করে হলেও পাঁচ হাজার বছর কিংবা তারও আগে পৌঁছে গিয়েছিল। আগের বঙ্গদেশে পাণ্ডু রাজার ঢিবি এবং উত্তর-পশ্চিমের মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় উত্খননে যে নগরগুলো বেরিয়ে এসেছে সেগুলো সাধারণ মানের হিজিবিজি নগর নয়, রীতিমত সুপরিকল্পিত মাস্টার প্ল্যানের অধীন গোছালো শহর। আজকের ঢাকা মহানগরেরও একটা মাস্টার প্ল্যান আছে। কিন্তু এ প্ল্যান মান্য করে নগর গড়ে না ওঠায় ঢাকা হয়ে গেছে ইট কংক্রিটের অরণ্য, যার অপ্রশস্ত আঁকাবাঁকা রাস্তাঘাট ধারণ ক্ষমতার বহুগুণ অধিক যানের ভিড়ে হয়ে পড়েছে যাতায়াত অনুপযোগী। কাণ্ডজ্ঞান বর্জিত নাগরিকদের নর্দমা ও ড্রেনে ময়লা ফেলায় বৃষ্টি হলেই শহর সাত হাত ময়লা দুর্গন্ধ পানির নিচে থাকে দিনের পর দিন। ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্যে নদী-খাল বিষাক্ত বর্জ্যে ভরাট হয়ে আশপাশের সব জমি হয়ে গেছে ফসল উত্পাদনের অনুপযোগী। নদী-খাল-বিলের পানিতে কারখানার কেমিক্যাল ও চাষের জমিতে ছিটানো কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে এসে পড়ায় মাছ ও জলজ প্রাণীর দফারফা হয়ে গেছে। এ হলো ভারতবর্ষের ছয়-সাত হাজার বছর পরের মানুষের কাণ্ড যারা জ্ঞানবিজ্ঞানে মহাশূন্য যুগে বসবাস করছে বলে দাবি করে। পাণ্ডুরাজার ঢিবির মানুষ আজকের বাংলাদেশের মানুষের চলাফেরা ও আচরণ দেখলে ভিরমি খেত।

কেবল বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের সব প্রান্তের মানুষের কাণ্ড-কারখানা ও আচরণ এ রকম হয়ে পড়ার নিশ্চয়ই কারণ আছে। উপমহাদেশে কেবল যে প্রথম পরিকল্পিত নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তা নয়। মানবাধিকার বলে হালে যে কথাটি বহুল উচ্চারিত এবং প্রচার করা হয় (ইংরেজের ইতিহাস পড়ে) তার সূচনা ঘটে ব্রিটেনে ব্যারণদের সঙ্গে রাজার ম্যাগনাকার্টা নামে একটি চুক্তি বা সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এবং যার প্রচলন হয় যুদ্ধ করে স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ও ফরাসি বিপ্লবের এনসাইক্লোপেডিস্টদের রচনার ফলস্বরূপ ফরাসি বিপ্লবের পর। আসলে সত্য হলো মানবাধিকারের শুধু নয়, সব জীবের পৃথিবীতে সসম্মানে সম-অধিকারে বেঁচে থাকার ভাবনা মহাবীর (জৈন তীর্থকর) নামক একজন ভারতীয় চিন্তাবিদের দ্বারাই প্রথম প্রচারিত হয় খ্রিস্টপূর্বকালে। আজ মানুষ অন্তরীক্ষ যুগে প্রবেশ করেছে। মানুষ চাঁদে পা রেখেছে এবং মনুষ্য নির্মিত যান দূরের কাছের সব গ্রহ প্রদক্ষিণ করে তাদের অবস্থা সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। এসব যানের একটি এখন সৌরমণ্ডলের গণ্ডি পেরিয়ে মহাকাশের ভিন্ন নক্ষত্রলোকের দিকে ধাবমান। এর সবই সম্ভব হয়েছে প্রাচীন ভারতীয়দের গণিতশাস্ত্রের শূন্য আবিষ্কার দ্বারা। সহজ গণনার পদ্ধতি শূন্য আবিষ্কৃত না হলে মানুষের পক্ষে ভৌত প্রযুক্তির এই বিকাশ সম্ভব হতো না।

ভারতীয়রা যে সময় এতটা এগিয়ে আজকের ব্রিটেন ও ইউরোপীয়রা তখন কাঁচা মাছ-মাংস খেত এবং গুহা ও পশুর চামড়ার তৈরি তাঁবুতে থাকত চামড়ার তৈরি জামা-জুতা পরে। সেই বর্বরতা ছাড়িয়ে আজ ইউরোপীয় ও তাদের বংশধর আমেরিকানরা কোথায় আর সাত হাজার বছর থেকে সুসভ্য ভারতীয়রা কোথায়? এ পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার দরুনই ব্রিটেনের পক্ষে সম্ভব হয় তাদের সব উপনিবেশসহ তাদের সাম্রাজ্যের মুকুট ইন্ডিয়াকে ‘স্বাধীন’ করে দিয়েও তাদের অধীন রাখা।

ব্রিটেনের দখলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু ছিল না। ১৮৫৭ সালে সংঘটিত ভারতব্যাপী সিপাহি বিদ্রোহের আগ পর্যন্তও ভারতীয়রা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা কী তা জানত না। ভারতবর্ষে বহু ধর্মের ও বহু সম্প্রদায়ের বাস। ভারতীয়দের প্রকৃতিই এমন যে, তারা সব মত ও পথের প্রতি সমান সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাপরায়ণ। ফলে যে যার মতো স্বাধীনভাবে তার নিজস্ব ভাবনার পথে চলতে পারত। ব্রিটেন তার ভারত সাম্রাজ্য ধরে রাখতে গিয়ে এ অবস্থার ইতি টেনে দিল। ভারতে হিন্দু বলে কোনো ধর্ম সম্প্রদায় ছিল না। বহু কোটি দেবদেবী ও দেবতা-দানবে বিশ্বাসী ভারতীয়রা নিজ নিজ অঞ্চলের দেবদেবীর আরাধনা করত। এ কারণে বাংলাদেশের উপাস্য দেবদেবীর সঙ্গে, উদাহরণ স্বরূপ, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের উপাস্য দেবদেবীর মিল নেই। আর্যরা বেদ উপনিষদ নিয়ে ভারতে স্থায়ী হওয়ার পর আর্য ব্রাহ্মণরা তাদের রচিত অনুশাসন দিয়ে সমাজ পরিচালনা শুরু করলে এবং তাদের রচিত দুই মহাগ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারতে সৃষ্ট চরিত্রাবলী সব নাগরিকের রোল মডেল হয়ে উঠলে ভারতীয় সমাজের সব সদস্য সেসব মান্য করে চলতে থাকে। অন্য ধর্মের যারাই ভারতবর্ষে এসে বসবাস করতে শুরু করে তারা, উদাহরণস্বরূপ, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও ভারতীয় সমাজের দুই মহাকাব্যে বিবৃত পিতা-মাতার প্রতি নিস্প্রশ্ন আনুগত্য, বড় ভাইবোনদের প্রতি ছোট ভাইবোনদের ভালোভাসা ও আনুগত্য, পিতার অবর্তমানে প্রথম পুত্রের পরিবারের দেখাশোনা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন স্বয়ংক্রিয়ভাবে মেনে চলতে থাকে। ফলে ভারতবর্ষে ঈশ্বর ও দেবতায় বিশ্বাস ভিন্ন ভিন্ন থাকলেও, ভারতবর্ষের বা মোগল আমল থেকে পরিচিত হিন্দুস্থানের সব অধিবাসীর সামাজিক আচরণ অভিন্ন হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, সব ভারতীয় ও হিন্দুস্থানীয় বিশ্বদৃষ্টি অভিন্ন হওয়ার কারণ হলো ভারতের যারা ধর্মান্তরিত ভিন্ন ধর্মাবলম্বী; যেমন—মুসলমান ও খ্রিস্টান তারা ধর্ম পালনের পদ্ধতি বদলালেও ভারতীয় হিসেবে তাদের সামাজিক আচরণ তো বদলাতে পারে না। এ কারণে উদাহরণস্বরূপ, বাংলার হিন্দুর সঙ্গে বাংলার মুসলমানের যত মিল, পশ্চিম এশিয়ার মুসলমানের সঙ্গে তার ধারে কাছেও সে মিল নেই। একইভাবে বাংলার মুসলমানের সঙ্গে বাংলার হিন্দুর যত মিল, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের হিন্দুর সঙ্গে তার ধারে কাছেও সে মিল নেই। তবে সব মিলে সারা ভারতবর্ষের মানুষের রোল মডেল অনুরূপ হওয়ায় সারা ভারতের বিশ্বাস নির্বিশেষে সব মানুষের চরিত্র মোটামুটি এক। চরিত্র যে এক তার সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ হলো ভারত-ইংল্যান্ড ক্রিকেট সিরিজ। এ সিরিজে ধবল ধোলাই হয়ে ভারতীয়রা শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। ভারতের হারার কারণ হিসেবে ইংরেজ এক সাবেক খেলোয়াড় ভারতীয় দলকে তুলনা করেছেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। তিনি বলতে চেয়েছেন আত্মবিশ্বাসের পারদের ওঠানামার কারণে বাংলাদেশ দল জেতা খেলায় যেমন হেরে যায়, ভারতীয় দলের অবস্থাও হয়ে গেছে তেমনি। মানুষ হিসেবে দৈহিক ও মানসিক গঠন উপমহাদেশের সব মানুষেরই যে এক, এ তারই প্রমাণ।

কিন্তু ব্রিটিশ তেলেসমাতি দেখিয়ে দিল মুসলমানদের বিপরীতে সব ভারতীয়কে হিন্দু বলে পরিচিত করিয়ে। মুসলমান শাসকের কাছ থেকে তারা ভারতবর্ষ দখল করায় ‘মুসলমান হিন্দুর প্রধান শত্রু’, ভারতের ইতিহাস এভাবে লিখে ইংরেজ হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলে। ব্রিটিশের লেখা ভারতবর্ষের ইতিহাস তিন আমলে বিভক্ত, যথা : হিন্দু আমল, মুসলমান আমল ও (শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান নয়) ব্রিটিশ আমল। ব্রিটিশ আমলকে ইংরেজ খ্রিস্টান আমল না বলে অভিহিত করে আধুনিক আমল বলে! ইংরেজের এই আধুনিক আমলের এতই গরিমা যে হাজার বছরের মধ্যে যা ভুলেও ঘটেনি, প্রতিবেশীর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তাই ঘটল; দেশ প্রথমে (১৯৪৭) দুই টুকরো এবং পরে (১৯৭১) তিন টুকরো হলো। ছয় কোটি মানুষ হলো নিজ ভিটেমাটি ছাড়া। লাখ লাখ নরনারী ও শিশু অতি নির্দয়ভাবে হলো খুন। হাজার হাজার নারী হারাল সম্ভ্রম। এর সবই প্রতিবেশীর দ্বারা। ভারতীয়দের এ দুর্দশা দেখে ইংরেজ মুচকি মুচকি শুধু হাসল। ইংরেজদের শরীরে আঁচড়টি লাগল না। এটা শাসক হিসেবে ইংরেজদের এক বিরাট কৃতিত্ব।

ইংরেজের স্বহস্তে তৈরি প্রাক-১৯৪৭ সব সম্প্রদায়ের ভারতীয় নেতাদের আহাম্মকি দেখলে আজ চোখ যায় কপালে উঠে আর কপাল চাপড়ানো ছাড়া উপায় থাকে না। তখন থেকে আজ প্রায় আট দশক কেটে যাচ্ছে। ইংরেজের শয়তানিটা, আরও বেশি কপাল চাপড়ানোর বিষয়, উপমহাদেশের একটি দেশের নেতাদেরও এখন পর্যন্ত ধরতে না পারা। শুধু তাই নয়, ইংরেজের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে মার্কিন ষড়যন্ত্র ও শয়তানি। উপমহাদেশের বিভক্ত তিন দেশের নেতারা একযোগে ওই শয়তানি নস্যাত্ করতে নিজেদের মধ্যেকার সব বিবাদ অচিরে মিটিয়ে ফেলবে তা নয়, তারা তার বদলে সাময়িক স্বস্তির জন্য করার চেষ্টা করছে একে অপরের সঙ্গে চুক্তি। চুক্তি বন্ধুর সঙ্গে হয় না, চুক্তি করে শত্রু দু’পক্ষ। চুক্তি করতে গেলে লাভ লোকসানের হিসাব করতে হয়। প্রবল পক্ষ সাধারণত দুর্বল পক্ষকে ঠকাতে চেষ্টা করে। ভারত-বাংলাদেশ যত চুক্তি এ যাবত্ হয়েছে দুর্বল পক্ষ বাংলাদেশ তা থেকে লাভবান হয়নি। হাসিনা-মনমোহন চুক্তি দ্বারা যে হবে না তাও অগ্রিম বলে দেয়া যায়।

উপমহাদেশের শান্তি ও অগ্রগতির জন্য যা করা দরকার তা এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের চুক্তি নয়। চুক্তি ছাড়া এটা সম্ভব প্রাক-১৯৪৭ পর্বে ভারতবর্ষ যেমন ছিল ঠিক তেমনটি করে ফেলা, তিন দেশের তিন রাজধানী ঠিক রেখে এবং সীমান্তরেখা শুধু মানচিত্রে রেখে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও ঘাতক রক্ষী উঠিয়ে নিয়ে। তাহলে ট্রানজিট ও করিডোর সমস্যা বলে কিছু থাকবে না। থাকবে না বাণিজ্যে শুল্ক অশুল্ক বাধা। থাকবে না অবাধে যাতায়াতের বাধা। থাকবে না নদীর পানি এক তরফা প্রত্যাহার দ্বারা ভাটির দেশের মরুকরণ ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি। তখন পুরো উপমহাদেশের ভৌগোলিক ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে যেমন ফারাক্কার কূপ্রভাব দূর করতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভারত ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশে গঙ্গা বা পদ্মা ব্যারাজ তৈরি করে দেবে। তাতে উপমহাদেশ হয়ে উঠবে মহাশক্তিধর একটি রাজনৈতিক সত্তা, যেটা পণ্ড করতে ব্রিটিশের যত তত্পরতা।

উপমহাদেশের এ রকম হওয়াটাই এখন সময়ের দাবি। চুক্তি সই করে স্থায়ী কিছু হবে না। যা দরকার তা চুক্তি নয়, ব্রিটিশ সৃষ্ট নষ্টামির অবসান। সে পথে নেতারা হাঁটবেন? উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ চায় তাদের সে পথেই হাঁটা এবং কালবিলম্ব না করে।